মুসলিম মনীষীদের জ্ঞানচর্চা: বিশ্বসভ্যতার প্রথম দীপাধার
ইসলামের প্রথম বাণী 'ইকরা' বা পড়ো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার হেরা গুহায় জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে অনুরণিত হয়েছিল এ বাণী। সে ঐশী ধ্বনিই মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রথম অনুপ্রেরণা। কাল-কালান্তরে এই একটিমাত্র শব্দতরঙ্গ জ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণায় মুসলিমদের উতলা করে তুলেছে।
জ্ঞানচর্চায় ইসলামের অনন্য অবদান
ইসলাম জ্ঞানচর্চায় যেটুকু গুরুত্বারোপ করেছে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম ও মতবাদ এতটা গুরুত্বারোপ করেনি। ইলম বা জ্ঞানের গুরুত্বে ও মাহাত্ম্যে কোরআন ও হাদিসে প্রচুর উদ্ধৃতি রয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়তম রাসুল (সা.)-কে শিখিয়েছেন জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া।
প্রতিটি মুসলিম নর-নারীকে জ্ঞানার্জনে উদ্বেলিত করতে রাসুল (সা.) বলেছেন, 'ইলম তথা জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।' (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)
রাসুল (সা.) জ্ঞানার্জনের চেতনা মুসলিমদের মধ্যে এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন যে তরুণ, বৃদ্ধ ও নর-নারী সবাইকে জ্ঞানচর্চার চেতনায় উজ্জীবিত করে দিয়েছিল। ফলে তাঁরা শুধু একটি হাদিসের জন্য এক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে মদিনা থেকে সুদূর সিরিয়ায় গমন করতেও পিছপা হতেন না।
বিশ্বসভ্যতায় মুসলিম পণ্ডিতদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা
মুসলিমরা কোরআনের তাফসির, হাদিস ও তার ব্যাখ্যা, সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্র, ভাষাবিজ্ঞান, ফিক্বাহ শাস্ত্রসহ অন্যান্য ধর্মদর্শনে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি জাগতিক সব বিদ্যায় বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন। আবহাওয়াবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আইনবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য সব ক্ষেত্রে মুসলিমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
যুগান্তকারী মুসলিম গ্রন্থসমূহ
অস্ত্রোপচার বিদ্যায় আবুল কাসেম জাহরাভির 'আত-তাসরিফ', চোখের ব্যাধি ও তার উপশমে আবুল কাসেম মাওসিলির 'আল মুন্তাখাব ফি ইলাজিল উয়ুন', রসায়নে জাবের বিন হায়্যানের বিভিন্ন গ্রন্থ, বীজগণিতে উমর খৈয়ামের 'কিতাবুল জাবর', অ্যালজেব্রাখ্যাত মুসা আল-খাওয়ারিজমীর 'হিসাবুল জাবরি ওয়াল মুকাবালাহ', চিকিৎসাবিদ্যায় আবু আলী ইবনে সিনার 'আল কানুন ফিত-তিব' সহ শতসহস্র জ্ঞানগ্রন্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের উজ্জ্বল স্মারক বহন করে চলছে।
পশ্চিমা স্বীকৃতি এবং আমাদের গর্বের ইতিহাস
এসব জ্ঞানগ্রন্থ আরবি থেকে লাতিন ও ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সুতরাং মুসলিমরাই বিশ্বসভ্যতার প্রথম ও প্রকৃত দীপাধার। আজকের আধুনিক বিশ্বের উন্নতি ও চোখ-ধাঁধানো উৎকর্ষের নেপথ্যে রয়েছে মুসলিম মনীষীদের অদম্য জ্ঞানসাধনা ও নিরলস বিদ্যাচর্চা।
বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ কার্লাইল লেখেন, 'আরবরা ছিল মরুচারী বেদুইন। যুগ যুগ ধরে তারা ছিল অবহেলিত। এরপর যখন তাদের মধ্যে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটল, তখন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হলো। এক শতাব্দী পার হতে না হতেই তারা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র জাহান আলোকিত করে ছাড়ল।'
এ কথা পাশ্চাত্য ও ইউরোপের বহু গবেষক অকপটে স্বীকার করেছেন। আমাদের এই গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জ্ঞানচর্চায় আমাদের পূর্বপুরুষদের অবদান কত বিশাল। আজকের বাংলাদেশেও সেই জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করার সময় এসেছে।