স্বাধীন অর্থনীতির সংগ্রাম: মুক্তির স্বপ্ন আটকে আছে কার হাতে?
১৯৭১ সালে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম আজও অসমাপ্ত। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক গভীর সংকটের মুখোমুখি, যেখানে বিদেশি প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা মিলে তৈরি করেছে এক জটিল পরিস্থিতি।
অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের নতুন চ্যালেঞ্জ
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সাম্প্রতিক ইকোনমিক আপডেট একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। দীর্ঘদিনের মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমলেও ব্যবসায়িক আস্থা দুর্বল, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, ব্যাংকিং খাত রয়ে গেছে ভঙ্গুর অবস্থায়।
এই পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত স্বাধীনতা শুধু পতাকা উত্তোলনে আসে না, আসে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলার, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
বিদেশি নির্ভরতার বিপজ্জনক চক্র
গত অক্টোবর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.১৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত বছরের ১০.৮৭ শতাংশের তুলনায় কিছুটা উন্নতি। কিন্তু এই উন্নতি কি প্রকৃত অর্থে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষণ, নাকি বিদেশি প্রভাবের ফল?
ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি শক্ত অবস্থানে থাকলেও ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ স্থবির। উচ্চ সুদহার, ব্যাংকগুলোর সতর্ক ঋণনীতি, দুর্বল বিনিয়োগ মনোভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ স্থবিরতার মূল কারণ। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশে।
স্বদেশি শিল্পের দুর্দশা
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, আমাদের স্বদেশি শিল্প চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। ২০২২ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না।
ক্ষুদ্রশিল্পের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে - এই তথ্য আমাদের গভীরভাবে চিন্তিত করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন।
রাজস্ব সংগ্রহের হতাশাজনক চিত্র
অক্টোবর ২০২৫-এ এনবিআর তিন উৎস থেকে সংগ্রহ করেছে ২৮ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, যা মাসিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আট হাজার ৩২৪ কোটি টাকা কম। এই ঘাটতি আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
মুক্তির পথ কোথায়?
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কি আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দেবে, নাকি নতুন ধরনের নির্ভরতা তৈরি করবে?
বহির্বাণিজ্যে মিশ্র প্রবণতা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ সামগ্রিক বাহ্যিক খাতকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। নভেম্বর ২০২ৄ থেকে অক্টোবর ২০২৫, এই সময়ে রিজার্ভ বেড়ে ২৪.৩৫ বিলিয়ন থেকে ৩২.৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
জাতীয় সংকল্প প্রয়োজন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো আজ আমাদের প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের। বিদেশি প্রভাব ও নির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মতো আমাদের অর্থনৈতিক পরিচয়ও রক্ষা করতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নির্বাচন একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক নির্দেশনা দিলে এবং নতুন সরকার ব্যবসাবান্ধব সংস্কার বিশেষত ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, আর্থিক শৃঙ্খলা, শক্তির নিরাপত্তা এবং রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ দ্রুত পুনরুদ্ধারের গতিতে ফিরতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই পুনরুদ্ধার কি হবে প্রকৃত স্বাধীনতার দিকে, নাকি নতুন ধরনের পরনির্ভরতার দিকে?