স্বাধীনতার অর্থনীতি সংকটে: ১৯৭১-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ গভীর সংকটের মুখে। ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছিলেন, সেই স্বনির্ভর অর্থনীতির লক্ষ্য আজও অধরা রয়ে গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখন অনেকগুলো 'যদি-কিন্তুর' ওপর নির্ভর করছে। দীর্ঘদিনের মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমলেও ব্যবসায়িক আস্থা দুর্বল, বিনিয়োগ স্থবির এবং ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
১৯৭১ সালে আমরা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই অর্জন করিনি, অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নও দেখেছিলাম। কিন্তু আজ ৫৪ বছর পর এসেও আমাদের অর্থনীতি বহিরাগত প্রভাবের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে।
তবে এই প্রবৃদ্ধিও নির্ভর করছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ওপর। অর্থাৎ আমাদের প্রবাসী ভাইবোনদের পাঠানো অর্থ এবং বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রয়ের ওপর। এটি প্রকৃত অর্থে স্বনির্ভর অর্থনীতির পরিচায়ক নয়।
ব্যাংকিং খাতে সংকট: জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার
মুক্তিযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজ চরম দুর্বলতার শিকার। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ স্থবির হয়ে আছে। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশে।
এই অবস্থা বেসরকারি খাতকে 'ক্রাউড-আউট' করছে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। উচ্চ স্প্রেড, এনপিএল এবং অপচয়জনিত ব্যয় বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থতা: স্বনির্ভরতার পথে বাধা
একটি স্বাধীন দেশের জন্য নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অক্টোবর ২০২৫-এ এনবিআর তিন উৎস থেকে সংগ্রহ করেছে ২৮ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, যা মাসিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আট হাজার ৩২৪ কোটি টাকা কম।
এই রাজস্ব ঘাটতি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এডিপি বাস্তবায়নেও ধীরগতি স্পষ্ট, যা ১৯৭১-এর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার পথে অন্তরায়।
শিল্প খাতের দুর্দশা: মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দূরে
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ জানিয়েছেন, ২০২২ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না।
বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে ক্ষুদ্রশিল্পের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা স্বনির্ভর শিল্প খাতের জন্য অশনি সংকেত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: স্থিতিশীলতার প্রয়োজন
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি ও রাজনীতি পাশাপাশি চলে, একে অপরের পরিপূরক।
তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যত দীর্ঘ হবে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি তত বাড়বে। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথেও সাংঘর্ষিক।
পথ এগিয়ে: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে
মূল্যস্ফীতি কমছে এবং রেমিট্যান্স-রিজার্ভ খাত শক্তিশালী থাকলেও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বিনিয়োগ সংকট, ব্যাংকিং অস্থিরতা, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ওঠানামার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নির্বাচন একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক নির্দেশনা দিলে এবং নতুন সরকার ব্যবসাবান্ধব সংস্কার বিশেষত ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, আর্থিক শৃঙ্খলা, শক্তির নিরাপত্তা এবং রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ দ্রুত পুনরুদ্ধারের গতিতে ফিরতে পারে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলাই হোক আমাদের লক্ষ্য।