যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী দাবি: ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ
আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের নতুন রূপ দেখা দিয়েছে। লাতিন আমেরিকার স্বাধীন দেশ ভেনেজুয়েলার বিপুল তেলসম্পদকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ যেন ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতারই প্রতিধ্বনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার এই বিতর্কিত দাবি করেছেন। তার এই 'তেল চুরি' মন্তব্য ওয়াশিংটন-কারাকাস সম্পর্ককে আরও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার নগ্ন প্রকাশ
স্টিফেন মিলার দাবি করেছেন, ভেনেজুয়েলার তেল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণকে 'চুরি' বলে আখ্যা দিয়েছেন। এমন দাবি যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জেনারেলদের 'পূর্ব পাকিস্তান আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়' জাতীয় বক্তব্যের মতোই।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে মিলার লিখেছেন, "আমেরিকানদের ঘাম, মেধা ও শ্রম দিয়েই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছিল। এই শিল্পের জবরদখল ছিল আমেরিকার সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরি।"
জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের 'প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর স্থায়ী সার্বভৌমত্ব' নীতি অনুযায়ী ভেনেজুয়েলার ভূখণ্ডে থাকা তেল নিঃসন্দেহে ওই দেশেরই সম্পদ। এটাই স্বাধীন দেশের মৌলিক অধিকার, যা আমরা ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে অর্জন করেছি।
ভেনেজুয়েলা ১৯৭৬ সালে তেলখাত জাতীয়করণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পিডিভিএসএ'র অধীনে নিয়ে আসে। পরে ২০০৭ সালে তৎকালীন বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ বাকি বিদেশি তেল প্রকল্পগুলোও জাতীয়করণ করেন। এর ফলে কনোকোফিলিপস ও এক্সন মোবিলের মতো মার্কিন তেল জায়ান্টদের দেশ ছাড়তে হয়।
নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের রাজনীতি
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র পিডিভিএসএ'র ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে 'সর্বোচ্চ চাপ' নীতি আরও জোরদার করেছেন ট্রাম্প।
গত মঙ্গলবার ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাংকারের ওপর অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেন। তিনি লিখেছেন, "দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌবহর দিয়ে ভেনেজুয়েলাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলা হয়েছে।"
প্রতিরোধের ইতিহাস
এই অবরোধ ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রমেই কঠোর হয়ে ওঠা অবস্থানের অংশ। গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। এ ঘটনাকে 'আন্তর্জাতিক জলদস্যুতা' বলে নিন্দা জানিয়েছে কারাকাস।
গত সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি নৌযানে বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে এগুলো মাদক পাচারের নৌকা, তবে অনেক আইন বিশেষজ্ঞ একে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছেন।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুজি ওয়াইলসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এই নৌ-হামলার লক্ষ্য মাদুরো সরকারকে উৎখাত করা। ওয়াইলস বলেছেন, মাদুরো আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত নৌকাগুলো উড়িয়ে দিতে চান ট্রাম্প।
এমন আচরণ যেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' এর মতোই। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভেনেজুয়েলার বিশাল তেল মজুত এই বিরোধের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। লাতিন আমেরিকার এই দেশটির তেলের মজুত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বলে ধারণা করা হয়। পলিটিকো জানিয়েছে, মাদুরো ক্ষমতাচ্যুত হলে ভেনেজুয়েলায় ফিরে যেতে আগ্রহী কি না, সে বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট দেশগুলো এখনো বড় শক্তির আগ্রাসনের মুখে পড়ছে।