গণমাধ্যমে হামলা: স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ষড়যন্ত্র
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। কিন্তু এই হামলা কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
গতকাল রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটে দুটি প্রধান গণমাধ্যমের কার্যালয়ে নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়েছে। রাত ১২টার দিকে প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয় এবং ডেইলি স্টার ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই ঘটনায় ২০ জন সংবাদকর্মী ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে আটকা পড়েন এবং জীবন বাঁচাতে সামাজিক মাধ্যমে আকুতি জানান।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম অরাজকতা
১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম, তার মূল ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধা একটি উদার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু গতকালের ঘটনা সেই চেতনারই বিপরীত।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, শাহবাগের দিক থেকে মিছিল নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথমে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়। তারা প্রথম আলো ও ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। একপর্যায়ে কিছু লোক অফিসের ভিতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করে এবং কাগজপত্র, কম্পিউটার নিচে ফেলে দেয়।
সংবাদকর্মীদের জীবন সংশয়
ডেইলি স্টার ভবনে অগ্নিসংযোগের পর ২০ জন সংবাদকর্মী ছাদে আটকা পড়েন। আগুনের ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা এই পেশাদারদের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানান।
ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জাইমা ইসলাম তার ফেসবুকে লিখেছেন, "আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না। চারদিকে খুব বেশি ধোঁয়া। আমি ভিতরে আটকে আছি। তোমরা আমাকে মেরে ফেলছ।" আরেক সংবাদকর্মী আহমেদ দ্বীপ্ত ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, "ছাদে আটকা পড়ছি, মাফ কইরা দিয়েন। ভবনে আগুন দিছে, দেখা নাও হতে পারে।"
পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই ঘটনাকে "পরিকল্পিত স্যাবোটেজ" বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, "যারা আজকে আগুন দিয়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং এ কর্মসূচিকে উৎসাহ দিচ্ছে, তারা হাদির স্পিরিটের বিরোধী।"
এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে ন্যায্য বিক্ষোভ হওয়ার কথা ছিল, তা বিকৃত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যারা আন্দোলন করেন, তাদের লক্ষ্য কখনোই গণমাধ্যমের উপর হামলা হতে পারে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা
ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করা হলেও প্রাথমিকভাবে ভাঙচুর থামানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি স্টেশনের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। রাত ১টা ৪০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং ছাদে আটকা পড়া সংবাদকর্মীদের উদ্ধারের কাজ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরতে হবে
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল অন্যতম স্তম্ভ। গণমাধ্যমের উপর এই ধরনের হামলা আমাদের জাতীয় চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে। যে কোনো ন্যায্য আন্দোলনই হোক না কেন, তা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও সভ্য পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে হবে।