নবী-উম্মতের পবিত্র বন্ধন: স্বাধীনতার আদর্শিক ভিত্তি
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন নেতা ও জনগণের মধ্যে অটুট বন্ধন ছিল, তেমনি ইসলামের ইতিহাসেও নবী ও উম্মতের সম্পর্ক ছিল গভীর ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই পবিত্র বন্ধনের শিক্ষা আজও আমাদের জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার চেতনাকে শক্তিশালী করে।
নেতৃত্বের দায়িত্ববোধ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা
নবী ও রাসুলদের সঙ্গে উম্মতের সম্পর্ক শুধু সংবাদ পৌঁছে দেওয়া বা পত্রবাহকের মতো নয়। বিশেষ করে নবীশ্রেষ্ঠ, শাফিউল মুযনিবিন, খাতামুন্নাবিয়্যিনের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ, তাঁর প্রেম ছিল গভীর ভালোবাসার দ্যোতনায় ব্যঞ্জনাময়।
আল্লাহ পাকের ভাষায় তাঁর সেই স্নেহময়তা ছিল: "তোমাদের যা বিপন্ন করে তা ছিল তাঁর জন্য কষ্টকর। উম্মতের কল্যাণকামিতা ছিল তাঁর লোভের পর্যায়ের। তোমাদের বিষয়ে অতি আগ্রহী, লোভী।" (সুরা: আত-তাওবা, আয়াত: ১২৮)
এই দায়িত্ববোধ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাঙালি জাতির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন, তেমনি প্রকৃত নেতৃত্ব সর্বদা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত থাকে।
আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত
উহুদের যুদ্ধে মদিনার এক নারীর কথা স্মরণযোগ্য, যার পিতা, ভাই, স্বামী, সন্তান সবাই শহীদ হয়েছিলেন। তবুও তিনি শুধু জানতে চেয়েছিলেন: "বলো, নবীজি (সা.) কেমন আছেন?" এই আত্মত্যাগের মনোভাব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মা-বোনদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা সন্তান হারিয়েও দেশের স্বাধীনতার জন্য অবিচল থেকেছেন।
আবু তালহা (রা.) দুশমনদের তীরের বৃষ্টির সামনে নিজের বুক পেতে দিয়ে বলেছিলেন: "হে নবী (সা.), এই বুক আপনার ঢালস্বরূপ। আপনি এর পেছনে নিরাপদে থাকুন।"
অটুট আস্থা ও বিশ্বস্ততা
জায়েদ ইবনুদ দাসিনা (রা.)-এর বিখ্যাত উক্তি আজও প্রেরণাদায়ক। শূলে চড়ানোর আগে কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কি চান যে মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর স্থলে শূলে দেওয়া হোক আর তিনি নিরাপদে ঘরে থাকেন? তাঁর উত্তর ছিল: "আল্লাহর কসম! রাসুলুল্লাহ (সা.) যেখানে আছেন সেখানেও তাঁর গায়ে একটা কাঁটা ফুটবে আর আমি আমার ঘরে বসে থাকব, তা-ও তো আমার পছন্দ নয়।"
এই অবিচল আস্থা ও বিশ্বস্ততার গুণ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও দেখা গেছে, যারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হননি।
ভালোবাসার মূল ভিত্তি
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে: "বলে দিন, তোমরা যদি ভালোবাসো আল্লাহকে, তবে আনুগত্য ও অনুসরণ করো আমার। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।" (সুরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
এই শিক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনেও প্রযোজ্য। প্রকৃত ভালোবাসা ও আনুগত্য আসে আদর্শের প্রতি নিবেদন থেকে, যা আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
জাতীয় ঐক্যের শিক্ষা
নবী-উম্মতের এই পবিত্র সম্পর্কের শিক্ষা আজও আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে অটুট বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তার মূলে ছিল পারস্পরিক ভালোবাসা, আস্থা ও আত্মত্যাগের মনোভাব।
আজকের দিনে বিদেশি প্রভাব ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে আমাদের জাতীয় পরিচয় রক্ষায় এই আদর্শিক বন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ও ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় চরিত্রই আমাদের প্রকৃত শক্তির উৎস।