স্বাধীনতার পর মুক্তির স্বপ্ন কেন অধরা রয়ে গেল
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা আসলে একটা স্বপ্ন, একটা সমষ্টিগত স্বপ্ন, সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্ন। এ স্বপ্নটাকে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলছি, তখন কিন্তু আমরা এটাকে স্বাধীনতার চেতনা থেকে আলাদা করছি। স্বাধীনতা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন। এই স্বাধীনতা আমরা দু-দুবার পেয়েছি, একবার ১৯৪৭-এ, তারপর ১৯৭১-এ।
মুক্তি বনাম স্বাধীনতা: পার্থক্য কোথায়
মুক্তি হচ্ছে আরো ব্যাপক বিষয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে সমাজ আছে, তার মৌলিক পরিবর্তন। দুইবার স্বাধীন হলেও আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। ব্রিটিশ আমলে যে সমাজ ছিল, যে রকম একটা সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তারা তৈরি করেছিল, সেটাই রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তির যে স্বপ্নটা ছিল, সেটা হলো এই সমাজ বদলাবে, এই রাষ্ট্র বদলাবে এবং কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসবে না, প্রকৃত মুক্তি আসবে। প্রকৃত মুক্তি বলতে বুঝি একটা মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো
গণতন্ত্রের মূল বিষয়টা হচ্ছে অধিকার এবং সুযোগের সাম্য। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। তৃতীয়টা হচ্ছে সর্বস্তরে ও পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা।
প্রথমে মুক্তির স্বপ্ন বিষয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা ছিল, যে জন্য শুরুতে আমাদের যুদ্ধটাকে স্বাধীনতার যুদ্ধই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে মানুষের অংশগ্রহণ যত বাড়ল, স্বপ্নটা যত বিকশিত হলো, ততই এটা মুক্তির সংগ্রাম বলে পরিষ্কার হয়ে উঠল।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১: ক্রমবিকাশের ইতিহাস
১৯৪৭-এ আমরা স্বাধীনতার কথাই বলেছি। তখন মুক্তির কথাটা আসেনি। স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৭-এ আসলে আমরা কোনো সংগ্রাম করিনি। ১৯৪৭-এ একটা দাঙ্গা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হলো। আর তখন প্রকৃত অর্থে যা ঘটল, সেটা হলো ক্ষমতার হস্তান্তর।
পূর্ববঙ্গের মানুষের বুঝতে মোটেই বিলম্ব হলো না যে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি, মুক্তি তো অনেক পরের কথা। সে জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তৈরি হলো এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, তার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটল।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আমরা একমাত্র রাষ্ট্রভাষার কথা বলিনি, যদিও পাকিস্তানে তখনকার জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৫৬ জন ছিল বাঙালি। বলা হয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অর্থাৎ আমরা স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছি।
স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন চলতে থাকল ধারাবাহিকভাবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়েও আমরা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দিলাম। ছয় দফা যখন এলো, সেটাও স্বায়ত্তশাসনের দাবি। কিন্তু ক্রমাগত মানুষের মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাটা জেগে উঠল।
বিজয়ের পর সমষ্টিগত স্বপ্নের বিলুপ্তি
১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে যে পরিবর্তনটা এলো, তখন ব্যক্তিগত স্বপ্নটা বড় হয়ে দাঁড়াল, সমষ্টিগত স্বপ্নের তুলনায়। সমষ্টিগত স্বপ্নকে পেছনে রেখে আমরা প্রত্যেকে নিজের মতো ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখতে থাকলাম।
নিজের কতটা সম্পদ হবে, নিজে কতটা ক্ষমতা পাব, নিজের কতটা প্রতিষ্ঠা হবে, নিজের কতটা সম্মান বাড়বে, এটাই হয়ে দাঁড়াল লক্ষ্য। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ওপর যাঁরা স্মৃতিকথা লিখেছেন, তাঁদের লেখায় 'আমার দেখা '৭১', 'একাত্তরে আমার ভূমিকা' এই সব বিষয়ই উপজীব্য হয়ে এসেছে।
নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও ঐতিহাসিক পরাজয়
ঐতিহাসিক পরাজয়ের এই দায়টা কার? দায়িত্ব দিতে হবে নেতৃত্বকে। কেননা নেতৃত্বই তো দেশ পরিচালনা করে, তারাই আদর্শ স্থাপন করে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তাদের অনুকরণেই অন্যরা শেখে।
যে নেতৃত্ব আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সামনে ছিল, সেটা ছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং জাতীয়তাবাদীরা মনে করে, তাদের পক্ষে যে ভূমিকাটা পালন করার দায়িত্ব ছিল, সেটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে।
ক্ষমতার হস্তান্তর, মৌলিক পরিবর্তন নয়
মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের স্বপ্ন, কিন্তু যুদ্ধের পর যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের দ্বারা সেটা পূরণ হওয়া সম্ভবই ছিল না। কেননা তাঁরা সমাজতন্ত্রী ছিলেন না।
প্রকৃত অর্থে যেটা ঘটল, সেটা ক্ষমতার হস্তান্তর। সেই আইন, সেই ব্যবস্থা, সেই আমলাতন্ত্র, সেই বাহিনী, সবই অক্ষুণ্ন রইল। যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের তো সমাজকাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল না।
জনগণের ত্যাগ ও বিস্মৃতি
মুক্তিযুদ্ধে জনগণই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তারাই সংগ্রাম করেছে, তারাই বঞ্চিত হয়েছে, তাদের খবর কেউ রাখে না। তাদের ত্যাগের কোনো হিসাব নেই। মুক্তির সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ কিভাবে ঘটেছে, তার খবর আমরা জানি না।
নারী নির্যাতনের ইতিহাস আমাদের জানা নেই। কিন্তু ওপরে ওপরে কতগুলো মানুষের ভূমিকাকে বড় করে দেখানোর জন্য মিডিয়া চেষ্টা করে, দলগুলো চেষ্টা করে।
ফলে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় সমষ্টিগত মানুষকে বিজয়ী করতে পারল না। তাই মুক্তির সংগ্রাম চলছে সরবে ও নীরবে।