একাত্তরের স্বপ্ন ভাঙার ইতিহাস: স্বাধীনতা পেয়েও মুক্তি হারানোর গল্প
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা আসলে একটা স্বপ্ন, একটা সমষ্টিগত স্বপ্ন, সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্ন। এ স্বপ্নটাকে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলছি, তখন কিন্তু আমরা এটাকে স্বাধীনতার চেতনা থেকে আলাদা করছি।
স্বাধীনতা বনাম মুক্তির প্রকৃত অর্থ
স্বাধীনতা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন। এই স্বাধীনতা আমরা দু-দুবার পেয়েছি, একবার ১৯৪৭-এ, তারপর ১৯৭১-এ। মুক্তি হচ্ছে আরো ব্যাপক বিষয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে সমাজ আছে, তার মৌলিক পরিবর্তন।
দুইবার স্বাধীন হলেও আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। ব্রিটিশ আমলে যে সমাজ ছিল, যে রকম একটা সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তারা তৈরি করেছিল, সেটাই রয়ে গেছে।
একাত্তরের সমষ্টিগত স্বপ্ন
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তির যে স্বপ্নটা ছিল, সেটা হলো এই সমাজ বদলাবে, এই রাষ্ট্র বদলাবে এবং কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসবে না, প্রকৃত মুক্তি আসবে। প্রকৃত মুক্তি বলতে বুঝি একটা মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
গণতন্ত্রের মূল বিষয়গুলো হচ্ছে:
- অধিকার এবং সুযোগের সাম্য
- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
- সর্বস্তরে ও পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১: ধারাবাহিক সংগ্রাম
১৯৪৭-এ আমরা স্বাধীনতার কথাই বলেছি। তখন মুক্তির কথাটা আসেনি। স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৭-এ আসলে আমরা কোনো সংগ্রাম করিনি। ১৯৪৭-এ একটা দাঙ্গা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হলো।
পূর্ববঙ্গের মানুষের বুঝতে মোটেই বিলম্ব হলো না যে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি। সে জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তৈরি হলো এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, তার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটল।
বিজয়ের পর সমষ্টিগত স্বপ্নের মৃত্যু
১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে যে পরিবর্তনটা এলো, তখন ব্যক্তিগত স্বপ্নটা বড় হয়ে দাঁড়াল, সমষ্টিগত স্বপ্নের তুলনায়।
সমষ্টিগত স্বপ্নকে পেছনে রেখে আমরা প্রত্যেকে নিজের মতো ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। নিজের কতটা সম্পদ হবে, নিজে কতটা ক্ষমতা পাব, নিজের কতটা প্রতিষ্ঠা হবে, এটাই হয়ে দাঁড়াল লক্ষ্য।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর যাঁরা স্মৃতিকথা লিখেছেন, তাঁদের লেখায় 'আমার দেখা '৭১', 'একাত্তরে আমার ভূমিকা', 'আমার '৭১' – এই সব বিষয়ই উপজীব্য হয়ে এসেছে। ব্যক্তিগত অর্জন, ব্যক্তিগত ভূমিকাই প্রাধান্য পেল।
নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও ঐতিহাসিক পরাজয়
ঐতিহাসিক পরাজয়ের এই দায়টা নেতৃত্বের। কেননা নেতৃত্বই তো দেশ পরিচালনা করে, তারাই আদর্শ স্থাপন করে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
যে নেতৃত্ব আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সামনে ছিল, সেটা ছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং জাতীয়তাবাদীরা মনে করে, তাদের পক্ষে যে ভূমিকাটা পালন করার দায়িত্ব ছিল, সেটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে।
ক্ষমতার হস্তান্তর, মুক্তি নয়
মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের স্বপ্ন, কিন্তু যুদ্ধের পর যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের দ্বারা সেটা পূরণ হওয়া সম্ভবই ছিল না। কারণ তাঁরা মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে চান না, শুধু ক্ষমতার হস্তান্তর চান।
প্রকৃত অর্থে যেটা ঘটল, সেটা ক্ষমতার হস্তান্তর। সেই আইন, সেই ব্যবস্থা, সেই আমলাতন্ত্র, সেই বাহিনী – সবই অক্ষুণ্ন রইল।
জনগণের অবহেলিত ত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধে জনগণই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তারাই সংগ্রাম করেছে, তারাই বঞ্চিত হয়েছে, তাদের খবর কেউ রাখে না। তাদের ত্যাগের কোনো হিসাব নেই। মুক্তির সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ কিভাবে ঘটেছে, তার খবর আমরা জানি না।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় সমষ্টিগত মানুষকে বিজয়ী করতে পারল না। তাই মুক্তির সংগ্রাম চলছে সরবে ও নীরবে।
যেটাকে পাকিস্তানি হানাদার ভাঙতে পারেনি, সেটাকে আমরা ভাঙলাম বিজয়ের পরে। বলা যায়, বিজয়ের পরে এটা আমাদের একটা ঐতিহাসিক পরাজয় যে আমরা সমষ্টি চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যক্তি চিন্তাকে বরণ করে নিলাম।