বেগম খালেদা জিয়া: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর। বেগম খালেদা জিয়া সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়লাভ করে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বের ইতিহাসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও স্বীকৃতি পান।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এরশাদ সরকারের শেষ বছরে দেশ পুরোপুরি বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এই নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।
তার বিশ্বস্ত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ও আর্থিক শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেন। ভ্যাট প্রবর্তন এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বতার দিকে এগিয়ে চলে।
তার প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশের জিডিপি গড়ে বছরে ৪.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, যা এরশাদ আমলের ৩.৬ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
আর্থিক সুশাসনের ভিত্তি
অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য তার সরকার গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩ প্রণীত হয়। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
নারী শিক্ষায় বিপ্লব
১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ চালু করা হয়। এই পদক্ষেপ স্বাধীন বাংলাদেশে নারী শিক্ষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।
১৯৯১ সালে স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের অনুপাত ছিল ৫৫ থেকে ৪৫। ১৯৯৬ সালে তা দাঁড়ায় ৫২ থেকে ৪৮। পাঁচ বছরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ প্রায় ত্রিশ লাখ বৃদ্ধি পায়।
১৯৯৩ সালের অক্টোবরে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, "এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিসেস জিয়া মেয়েদের শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণকে অত্যন্ত জোর দিচ্ছেন।"
তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থান
বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় ২৯ শতাংশ। বেগম জিয়া দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে তৈরি পোশাক কারখানা ছিল ৮৩৪টি। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৫৩টিতে। এই সময়ে রপ্তানি আয়ও সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।
মানবিক নেতৃত্ব: রোহিঙ্গা ইশ্যু
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয় এবং প্রায় দুই লাখ সত্তর হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বেগম জিয়া তাদের আশ্রয় দেন এবং দ্রুত প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেন।
১৯৯২ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট বুশকে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৩ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয় মিয়ানমার।
দুর্যোগ মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা
১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় গোর্কি আঘাত হানলে খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় ছিল মাত্র দুই মাস। তিনি নিজে উপকূলে গিয়ে উদ্ধারকাজ তদারকি করেন। তার আহ্বানে বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যরা "অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল" নামে ঐতিহাসিক মানবিক ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেয়।
অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার ১৯৯৩ সালে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। এই সবুজবেষ্টনী পরবর্তী সময়ে বহু ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পরিবেশ সংরক্ষণে অগ্রণী
পরিবেশ রক্ষায় তার সরকারের বড় পদক্ষেপ ছিল ১৯৯২ সালে প্রথম জাতীয় পরিবেশ নীতি প্রণয়ন এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাস।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার নেতৃত্বে দেশ বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাবলম্বতার পথে এগিয়ে চলে।