স্বাধীন বাংলার মৎস্য সম্পদ: ভারতীয় বাজারে আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি
১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজ সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ ভারতের সাত রাজ্যে আমাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আগরতলার বাসিন্দা প্রাক্তন ব্যাংক কর্মকর্তা মনোজ চৌধুরীর কণ্ঠে শোনা যায় বাংলার মাছের প্রতি গভীর ভালোবাসা: "মাছের আসল স্বাদ তো বাংলার মাছে।"
আমাদের মৎস্য সম্পদের বিজয়গাথা
ভারতের Seven Sisters নামে পরিচিত উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যে বাংলাদেশের মাছের যে ব্যাপক চাহিদা, তা আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশের মানুষ আমাদের রুই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাশ, টেংরা, পাবদার স্বাদে মুগ্ধ।
আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি মূল্যের মাছ রপ্তানি হচ্ছে। গত সোমবার একদিনেই রপ্তানি হয়েছে দেড় কোটি টাকার মাছ। প্রতি কেজি মাছ যাচ্ছে আড়াই ডলার দরে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে।
ভৌগোলিক সুবিধা এবং আমাদের প্রাধান্য
ভারতের Seven Sisters রাজ্যগুলো মূলত স্থল ও পাহাড় বেষ্টিত। সমুদ্র কিংবা বড় নদী না থাকায় স্থানীয় মাছের সংকট রয়েছে। আমাদের মাছ স্বাদে ভালো, সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় সেখানে বিরাট বাজার তৈরি হয়েছে।
আখাউড়া স্থলবন্দর মাছ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ফারুক জানান, "দিন দিন ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা বেড়ে চলছে। ওপারের বাজার বাংলাদেশের মাছের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।"
রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও অর্থনৈতিক শক্তি
গত বছর চিন্ময় দাস গ্রেপ্তার ইস্যুসহ বিভিন্ন কারণে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিলেও, ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটলেও, আমাদের মাছের চাহিদা অব্যাহত থেকেছে। এটি প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কতটা শক্তিশালী।
এ বছরের ডিসেম্বরেও সেই চাহিদা অটুট রয়েছে। গত শুক্রবার ৭০ টনেরও বেশি মাছ রপ্তানি হয়েছে আখাউড়া বন্দর দিয়ে। সপ্তাহে পাঁচ দিন এই বন্দর দিয়ে নিয়মিত মাছ রপ্তানি অব্যাহত রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নেসার উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, রপ্তানি কাগজপত্রের জটিলতা এবং মাছ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত শেডের অভাব রয়েছে। তবে অনলাইন পদ্ধতি চালু করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
আখাউড়া উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাছও এই বন্দর দিয়ে ভারতে যাচ্ছে। প্রতিটি মাছের জন্য 'ফিশ হেলথ সার্টিফিকেট' প্রদান করা হয় যা আমাদের গুণগত মানের প্রমাণ।
এই মৎস্য রপ্তানি শুধু একটি বাণিজ্যিক সাফল্য নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ তার প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে বিশ্ব বাজারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলছে।